বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:২২ অপরাহ্ন
ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি॥ ময়মনসিংহের ভালুকায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠা অনুমোদনহীন মালিকানাধীন ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালে’ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে হসপিটালটির বিরুদ্ধে চিকিৎসার নামে ব্যবসা, প্রতারণা, রোগী ভোগান্তিসহ প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ উঠছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে যেসব ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সে সকল ডাক্তারদের অনেকেরই কোনো ডাক্তারি সনদ নেই, তারা দেশের বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী নামিদামী হাসপাতালে কর্মরত পরিচয় দিয়ে দেখছেন রোগী।
জানা গেছে, নামীদামি প্রতিষ্ঠানের নামের আগে-পরে কিছু শব্দ পরিবর্তন করে চিকিৎসার নামে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, উপজেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের স্কয়ার মাস্টারবাড়ী এলাকায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটাল’। পপুলার শব্দটিকে পুঁজি করেই মূলত তাদের এই প্রতারণা। ইতমধ্যে প্রকৃত নামের আদলে সরকারী নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই চিকিৎসার নামে ব্যবসা, প্রতারণা, রোগী ভোগান্তির অভিযোগ উঠেছে হসপিটালটির বিরুদ্ধে। গত ১১ সেপ্টেম্বর বিকালে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার গোপালগঞ্জ গ্রামের স্বপন মিয়ার স্ত্রী গর্ভবতী কুলছুম বেগম (২৫) মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালে অদক্ষ নার্সদের তত্ত্বাবধানে একটি জীবিত ছেলে সন্তান প্রসব করেন। বাচ্চাটির পিঠে ও পায়ে অতিরিক্ত আঘাতের ফলে ও হসপিটাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বাচ্চাটি মারা যায় এমনটি বলেন মৃতের স্বজনরা।
কান্নারত অবস্থায় কুলছুম বলেন, আমার বাচ্চা সুস্থ ভাবে জন্মেছে, আমার বাচ্চা কান্না করছে, চোখ মেলে তাকাচ্ছে, আমি বললাম আমার বাচ্চাকে আমার কোলে দেন, আমি দেখি, আমাকে দেখতেও দেয়নি পরে রাতে জানতে পারি আমার বাচ্চা মারা গেছে। আমি আমার জীবিত বাচ্চাকে ফেরত চাই। কুলছুম বেগমের স্বামী মোঃ স্বপন বলেন, আমার স্ত্রীর প্রসব ব্যাথা অনুভব হলে আমি আমার স্ত্রীকে শনিবার বিকালে ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালে’ নিয়ে যাই তখন হসপিটাল কর্তৃপক্ষের সাথে ১৬হাজার টাকা চুক্তি হয় অপারেশনের জন্য, আমি ১০হাজার টাকা জমা দেই। চুক্তিতে অপারেশনের কথা থাকলেও পরে অদক্ষ নার্স দ্বারা নরমাল ডেলিভারি করেন এবং সুস্থ ভাবে একটি ছেলে বাচ্চার জন্ম হয়।
আমি দেখলাম বাচ্চা কান্না করছে পরে আমাকে বললো ঔষধ কিনে আনতে, আমি ঔষধ কিনে দিছি, এর কিছু সময় পরে আমাকে একটি কাগজ দিয়ে বলেন, বাচ্চাটিকে দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, বাচ্চাটি মারা গেছে। স্বপন আরও বলেন ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালে’ থাকা অবস্থায় বাচ্চাটি মারা গেছে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। মৃতের মা বলেন, হসপিটাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় আমার বাচ্চা মারা গেছে, আমি তাদের বিচার চাই।
এছাড়াও গত মাস তিনেক পূর্বে ভুল চিকিৎসায় আমেনা খাতুন (৬৫) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। উপজেলার দক্ষিণ হবিরবাড়ি গ্রামের মৃত মোতালেবের স্ত্রী আমেনা খাতুনকে বুকের ব্যথা নিয়ে মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালে ভর্তি করা হয়। পরে রোগীকে ইসিজি করে হাসপাতালের ডাক্তার সৌরভ কুমার সাহার নির্দেশে এক নার্স রোগীকে ইনজেকশন পোশ করেন। ইনজেকশন পোশ করার সাথে সাথেই রোগী মৃত্যুর কূলে ঢলে পড়েন। ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন হাসপাতাল ঘেরাও করে বিক্ষোভ শুরু করলে খবর পেয়ে ভালুকা মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাত তিনটা পর্যন্ত সময় লাগে। এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হাসপাতালের অনুমোদন সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।
স্থানীয় লোকজন জানান, ‘পপুলার’ শব্দটি ব্যবহার করে রোগীদের চোখে ধুলা দেয়া হচ্ছে। লাইসেন্স না নিয়েই পরিচালিত করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসহায় রোগীদের কাছ থেকে। এই হাসপাতালের সাথে ঢাকার পপুলারের কোন যোগসূত্র নেই।
নাম প্রকাশ না কারার শর্তে চিকিৎসা নিতে আসা এক ভোক্তভুগি পরিবার জানান, আমি আমার মাকে (১৩ই আগষ্ট) শুক্রবার কমড় ব্যাথার জন্য ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালে’ ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাই, ডাক্তার দেখে তখন একাধিক পরিক্ষা দেন, পরিক্ষার সকল রির্পোট দেখে ডাক্তার বলেন, পিত্তথলিতে টিউমার হয়েছে অপারেশন করাতে হবে এবং এক সপ্তাহের ঔষধ লিখে দেন, এক এক সপ্তাহ ঔষধ খাওয়ানোর পরে রোগীর আরও জটিল হলে (২০শে আগষ্ট) শুক্রবার আবারও নিয়ে আসি এই হসপিটালে তখন নতুন করে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করেন অন্য আরেকজন ডাক্তার তিনি বলেন, এটি টিউমার নয়, পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে যত সম্ভব জরুরী অপারেশন করাতে হবে। তখন আবার নতুন কিছু ঔষধ লিখে দেন সেগুলো খাওয়াতে বলেন, (২২শে আগষ্ট) রবিবার অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই, সেখানে যাওয়ার পর সার্জারী বিভাগের ডাক্তার পরিক্ষা করে বলেন, ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালের’ পরিক্ষার সাথে আমাদের পরিক্ষার মিল পাওয়া যাচ্ছেনা যে কারনে অপারেশন করা যাবেনা এবং তিনি বলেন ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালের’ পরিক্ষায় যে কথা বলা হয়েছে আসলে সে কারনে কমড়ে ব্যাথা হওয়ার কথা না, তখন আমাকে বলেন একজন মহিলা গাইনী ডাক্তার দেখাতে, আমি আমার মাকে নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ সার্জন ডাঃ সবিতা ধরকে দেখাই সবিতা ধর বলেন এটা পাথর বা টিউমার কেনাটাই না, আমাদের পরিক্ষায় এমন কিছু পাইনি অপারেশনের প্রয়োজন নেই।
ভোক্তভুগি বলেন ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালে’ চিকিৎসা নিতে গেলে রোগীকে আরও ভোগান্তি পোহাতে হয়। আরও একজন ভোক্তভুগি বলেন- আমি সামান্য বুকে ব্যাথা নিয়ে ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালে’ গিয়েছিলাম চিকিৎসা নিতে আমাকে পাঁচ হাজার টাকার পরিক্ষা-নিরিক্ষা করে কোন প্রকার প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়ায় আমাকে দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়, আমি তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে না গিয়ে একজন ফার্মেসী ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নেই এবং এক ঘন্টার ব্যবধানে পুরপুরি সুস্থ্যতাবোধকরি। ‘মাস্টারবাড়ী পপুলার হসপিটালে’ শুধু রোগীদের কাছ থেকে শুধু টাকা নেন টাকার পরিমানে কাক্সিক্ষত সেবা বা চিকিৎসা দেয়না। এই হাসপাতালটিতে সকল পরীক্ষায় আদায় করা হয় অতিরিক্ত টাকা। যদিও কোন চিকিৎসক না থাকে তবুও যে কোন রোগী গেলেই মিলে তাদের কাছে চিকিৎসা।
এই হাসপাতালটির অনুমোদনের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায় যে সরকারী নিয়ম নীতি অনুসারে যে সকল প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন নিতে হয় তাদের মধ্যে দু-চারটি বাদে সে সকল কোনটারই অনুমোদন নেই। অবৈধ ভাবে সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসা সেবার নামে ব্যবসা।
হাসপাতালটির মালিক কাজ্বী মেহেদী হাসান লিপু বলেন, মাওনা-ভালুকার মধ্যে সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসা দিচ্ছি, রোগীরা আমার এখানে সঠিক চিকিৎসা না পেলে কোথাও পাবেনা, সিভিল সার্জন স্যার আসছিলো অনুমোদন দিয়ে গেছে। হাসপাতালটির মালিক কাজ্বী মেহেদী হাসান লিপুর সাথে, সরকারি নিয়মে একটি হসপিটাল চালাতে যে সকল প্রতিষ্ঠানের সনদ নিতে হয় তার মধ্যে কয়টি সনদ আছে এমন প্রশ্নে তিনি সঠিক কোন জবাব দিতে পারেননি।
হাসপাতালের ট্রেড লাইসেন্সের ব্যাপারে হবিরবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহাম্মেদ বাচ্চু বলেন- আমি শর্ত সাপেক্ষে এই লাইসেন্স দিয়েছি। যদি সরকারী নীতিমালা অনুসারে সকল অনুমতি না নেয় ও কার্যক্রম পরিচালনা না করে তবে এই লাইসেন্সের কার্যকারীতা থাকবে না।
ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য প.প. কর্মকর্তা ডাক্তার মাহফুজ আরা বেগম জানান, সিভিল সার্জন স্যারের সাথে কথা বলে তদন্ত করে শীঘ্রই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ নজরুল ইসলাম জানান, আমি হাসপাতালটি পরিদর্শন করেছি, সিজারিয়ান অপারেশনেসহ হাসপাতালটির চুড়ান্ত কোন অনুমোদন দেয়া হয়নি। যে সকল অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হবে, প্রমাণ পেলে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়া হবে।